২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার শেষ পর্যায়ে
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে চালানো ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ১৩ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। কিন্তু এখনো বিচারের অপেক্ষায় আছে ওই ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের পরিবার।
অবশ্য মামলা পরিচালনায় যুক্ত সরকারপক্ষের কৌঁসুলিরা বলছেন, মামলার বিচার শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আগামী কিছুদিনের
মধ্যে এই মামলার রায় হতে পারে। এখন আসামিপক্ষের সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। সাফাই সাক্ষ্য শেষ হলে হবে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন। এরপরই রায়। তবে এই প্রক্রিয়া শেষ হতে কত দিন লাগবে, তা তাঁরা বলতে পারেননি।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়ংকর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ওই হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২২ জন নিহত হন। গুরুতর আহত হন শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কয়েক শ নেতা-কর্মী। তাঁদের অনেকে আজও শরীরে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার নিয়ে দুঃসহ জীবন যাপন করছেন।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে অবস্থিত ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিশেষ এজলাসে এই মামলার বিচারকাজ চলছে। এ পর্যন্ত জঙ্গিনেতা মহিবুল্লাহ ওরফে অভি, মাওলানা আবু জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, আবু জান্দালসহ ১২ জনের সাফাই সাক্ষ্য দেওয়া শেষ হয়েছে। আগামী ২২ আগস্ট বাকি সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য আছে।
রাষ্ট্রপক্ষে এই মামলার প্রধান কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মামলা দুটিতে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করা ছিল রাষ্ট্রপক্ষের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সেটা সফলভাবে শেষ হয়েছে। তিনি বলনে, ৪৯১ জন সাক্ষীর মধ্যে মেজর জেনারেল সাদিক হাসান রুমি, প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মহীউদ্দীন খান আলমগীর, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক প্রাণ গোপল দত্তসহ ২২৫ জনের সাক্ষ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।
শেখ হাসিনাকে সাক্ষী হিসেবে আদালতে উপস্থাপন না করার বিষয়ে সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতেই এই হামলা হয়েছিল। শেখ হাসিনা বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে হাজির করা হলে অনেকেই প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করতেন।
সম্পূরক অভিযোগপত্রের সাক্ষী আবদুর রশিদ সম্পর্কে বলেন, তাঁকে আদালতে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। আদালতে সাক্ষী হিসেবে যে হাকিমের কাছে তিনি জবানবন্দি দিয়েছিলেন, সেই বিচারক সাক্ষ্য দিয়ে তাঁর জবানবন্দি প্রদর্শন ও শনাক্ত করেছেন। এতে মামলার কোনো ক্ষতি হবে না।
আসামিপক্ষের আইনজীবী আবদুস সোবহান তরফদার প্রথম আলোকে বলেন, দুটি মামলায় আসামিপক্ষের সাফাই সাক্ষ্য চলছে। আর কত জন সাফাই সাক্ষী উপস্থাপন করবে, তার ওপর নির্ভর করছে যুক্তিতর্ক শুরু হওয়া না-হওয়া।
আসামিপক্ষের আরেক আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, মামলায় সরকারের চাপ রয়েছে। তাই সরকার যেমন চাইবে সেভাবেই রায় হবে।
আদালত সূত্রে জানা যায়, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর থেকেই নৃশংস ওই হত্যাযজ্ঞের তদন্ত ভিন্ন খাতে নিতে নানা চেষ্টা করা হয়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে নতুন করে তদন্ত শুরু করে। বেরিয়ে আসে অনেক অজানা তথ্য। ২০০৮ সালের জুনে বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তাঁর ভাই তাজউদ্দিন, জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি-বি) নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। তদন্তে বেরিয়ে আসে, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ওই হামলা চালানো হয়েছিল। হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড এসেছিল পাকিস্তান থেকে।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই এ-সংক্রান্ত হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা দুটির বিচার শুরু হয়। ৬১ জনের সাক্ষ্য নেওয়ার পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার এসে এর অধিকতর তদন্ত করে। এরপর বিএনপির নেতা তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরী, জামায়াতের নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ ৩০ জনকে নতুন করে আসামি করে ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। এরপর দুই অভিযোগপত্রের মোট ৫২ আসামির মধ্যে তারেক রহমানসহ ১৮ জনকে পলাতক দেখিয়ে বিচার শুরু হয়। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কয়েকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা আদালতে সাক্ষ্য দেন, যাঁরা জোট সরকারের আমলে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) ও র্যাবের গোয়েন্দা শাখায় কর্মরত ছিলেন।
মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিএনপি নেতা তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবর, আবদুস সালাম পিন্টু, শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদসহ ৫২ জন আসামির মধ্যে ৪১ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধসহ হত্যা, হত্যাচেষ্টা, কর্তব্যকাজে অবহেলার অপরাধে অভিযোগ গঠন করা হয়। আর এই মামলায় মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমীন উদ্দিন, লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার, লে. কমান্ডার (অব) সাইফুল ইসলাম ডিউক, সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী, সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান, সাবেক সুপার ওবায়দুর রহমান খানসহ তদন্ত কর্মকর্তা রহুল আমীন, আবদুর রশিদ ও মুন্সী আতিকুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলার আলামত নষ্ট ও কর্তব্যকাজে অবহেলা করার অপরাধে অভিযোগ গঠন করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ আনা হয়নি। অন্য মামলায় তিন আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় বর্তমানে আসামির সংখ্যা ৪৯।
আর বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় ৪১ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। ১১ জনকে মামলার অভিযোগ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আসামির সংখ্যা ৩৮।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সিআইডি এই মামলার অধিকতর তদন্ত করে এবং ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়। তাতে আরও ৩০ জনকে আসামি করা হয়। আসামিদের মধ্যে পুলিশের সাবেক ছয়জন কর্মকর্তা, খালেদা জিয়ার ভাগনে সাইফুল ইসলাম ও সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর আরিফুর রহমান জামিনে আছেন। বাবর, পিন্টুসহ ২৩ জন আসামি কারাগারে আছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতের নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ এবং সিলেটে সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা ও তিনজনকে হত্যার মামলায় হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ও শরীফ শাহেদুল ওরফে বিপুলের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় তাঁদের এই মামলার আসামির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। তারেক রহমানসহ ১৮ জন পলাতক। পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করা হয়েছে।
Comments are Closed